(Read this post in English, by clicking here. )
লিখেছেনঃ আভেরি সাহা। অনুবাদ করেছেনঃ মৈনাক বিশ্বাস ও সুদীপ পাল।
তুসু পার্বণ (টুসু পরব বা টুসু পুজো নামেও পরিচিত) গ্রাম বাংলার এক উপজাতিক পার্বণ। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর— এই জেলাগুলিতেই এই টুসু পরব উদযাপিত হয়। টানা একমাস ধরে চলা এই পার্বণের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল টুসু গান—একধরনের লোকগান, টুসুর খাবার ও মেলা। এই টুসু পার্বণ শেষ হয় মকর সংক্রান্তিতে টুসুর বিসর্জন দিয়ে। এই টুসু পরবে পুরুলিয়ার দেউলিঘাটাতে আভেরি-দি কে, তাঁর পেপারের জন্য সঙ্গ দিচ্ছিলাম।
“প্রতিবছরের সেই পাটিসাপ্টা স্বাদ ছেড়ে ২০১৪র পৌষ সংক্রান্তি আমার জীবনে এক নতুন ভাবে কাটালাম। ১৪ই জানুয়ারি আমি ও এক উত্সাহী চিত্রগ্রাহক/ ফোটোগ্রাফার অনির্বাণ চরম আশা ও উত্তেজনা নিয়ে দুইজনে বেড়িয়ে পড়লাম দেউলঘাটার দিকে টুসু ভাসান দেখতে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমি একটু গা-ছাড়া ভাবেই পুরুলিয়া গেছিলাম একমাস ধরে চলা টুসুর কিছুর আচার-আচরণ দেখতে। আরও হতাস হলাম যখন জানলাম এই মকরসংক্রান্তিতেই টুসুর চৌডালা কংসাবতীর জলে বিসর্জন হবে। টুসুকে একমাস ধরে পুজো করার প্রথাটাও সেকেলে। বোধ হয় প্রথার সঙ্গে আধুনিকতার সামঞ্জস্যের কোন পথ নেই। তবুও কাউকে তো এর জন্য পথ তৈরি করতে হবে।
যাই হোক, ওইটুকুতেই অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। টুসু ভাসান এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সে শুধু রঙের ভাসান। উজ্জ্বল রঙিন চৌডালা, রঙ-বেরঙের পোশাকে মেয়েরা, সুপুরুষ দর্শক— সব মিলিয়ে এক উদ্যম আনন্দের অনুষ্ঠান যা ওই মেঘলা ঠাণ্ডা দিনকেও উজ্জল করে তুলেছিল। চৌডালা গুলো কাঠ, বাঁশের কাঠামোর, রঙিন কাগজ, পুতুল আরও অনেক কিছু দিয়ে সাজানো যা সেই টুসু দেবীকেই রূপ দেয়। এই পার্বণ শুধুমাত্র মেয়েদের, কুমারী মেয়েরা সেই চৌডালা তৈরি করে, নাহলে স্থানীয় বাজার থেকে সেগুলো কেনে। সকালের পুণ্য স্নানের পর মেয়েরা দলে দলে টুসুর গান গাইতে গাইতে টুসুকে নিয়ে নদীর দিকে যায়। দুপুরের মধ্যে নদীতীর টুসুনিতে ভরে যায়; সঙ্গে থাকে প্রচুর দর্শক, খাবারের দোকান বসে, এক কথায় ছোটো মেলা বসে। মাইকের জোর শব্দে টুসুর গান চলতে থাকে আর শহুরে ফটোগ্রাফারদের ভিড় জমে ‘পারফেক্ট ফ্রেম’-এর জন্য। মেয়েরা যখন নদীর বুকে হাঁটু-জলে ছল ছল শব্দে যেতে থাকে, তখন ছেলেদের মধ্যে উল্লাসধ্বনি ওঠে, মনে রাখা ভালো, এটা কোন খারাপ উদ্দেশে নয়, এটা শুধুমাত্র সেই প্রাণশক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। যদিও আমাকে বলা হয়েছিল যে কখনও কখনও এটা বিশৃঙ্খল, হাতের বাইরে চলে যায়। অনেক রূপে টুসু পুজিতা হয়—কখনো মেয়ে, কখনো বন্ধু, কখনো সখি রূপে; একজন দেবীর চেয়ে এই টুসু যেন ঘরেরই কেউ একজন। কথিত আছে, টুসু বা টুসুমণি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল নিজের ভালোবাসা, নিজের স্বামী, নিজের লোকেদের জন্য। তাই মেয়েরা টুসুকে বিসর্জন দেয় ও প্রার্থনা করে তাদের ভালবাসার স্বামীর জন্য ও নিজের সতীত্ব অটুট রাখার জন্য। এই সময় ছেলেরা নিজেদের পাণিপ্রার্থী হিসেবে প্রকাশ করার সুযোক পায়, আর এই ভাবেই এই পার্বণ প্রেমনিবেদনের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। এই সময় ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে, কখনো কখনো তা মারামারি অথবা বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে শেষ হয়। এই টুসু পরবকে একধরনের কৃষি-উত্সবও বলা চলে যা উর্বরতাকেই সূচিত করে। উপজাতি-অধ্যুষিত ছোটোনাগপুরের মালভূমিতে; পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদেনীপুরে; ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে আর উড়িষ্যার ময়ুরভণ্ড ও কেওঁঝাড় জেলায় এই টুসু পরব পালিত হয়। বিকেল ৩টে নাগাদ বিসর্জন শেষ, আস্তে আস্তে দিনের আলোও কমে আসছে, তখনও দূরে কিছু ছেলে-মেয়েদের প্রেমালাপে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে, চড়ুইভাতির শেষে সব বাঁধাছাঁদা চলছে, লোকেরা গ্রামের ফিরছে; আনন্দমুখর দিনের প্রচ্ছায়া ধীরে ধীরে জীবন ও কাজের উপচ্ছায়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দুদিন পরেই পূর্ণিমা, গোলাকার চাঁদ ততক্ষণে পরিষ্কার আকাশে জ্বলজ্বল করছে। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টুসু পরব দেখতে আবার আসব, তবে এই বার অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে টুসুর আগমনে।”
সৌভিক চ্যাটার্জি আমাদের টুসুর এক লোকগান দিয়েছেন:
“যা যা টুসু যা যা লো,
দেখা গেছে তোর পিরিত লো,
তোর পিরিতে মন মানে না,
বলি তোর পিরিতে আগুন জ্বলে না…”
সঙ্গী হয়ে থাকুন, পেজ টি কে ফেসবুকে লাইক করুন ” অনির্বাণ সাহা ব্লগ / ফটোগ্রাফি” ।