মল্লভুম বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত ” রাবন – কাটা নাচ ” ও একটা লোকসংস্কৃতি।বিষ্ণুপুরের অস্থলে কাতান্ধারে রঘুনাথ জিউ – এর সামনে এই নাচটি শারদীয়া উৎসবের এক বিশেষ উপসংহার হিসেবে বরাবর অনুষ্ঠিত হয়।বিষ্ণুপুরের নিমতলায় অবস্থিত রঘুনাথ জিউ এর অস্থলে রাম, সিতা, লক্ষ্মণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুজিত হয়ে আসছেন সুদুর অতীত থেকে। এখানেই রাবন কাটা নাচ অনুষ্ঠিত হয়। নাচের বিষয়বস্তু হল – রাম রাবনের যুদ্ধ ও যুদ্ধ শেষে রাবন বধ।
এই বহু প্রাচীন নাচ , বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় বলা চলে । গত বছর অনির্বাণ দা যখন আমায় দশমীর দিন ফোন করে যাবো কিনা জিজ্ঞেস করল , বিনা বাক্যব্যয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুরের পথে। হাওড়া থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরে রাত ৯ টার সময় নামলাম বিষ্ণুপুর ষ্টেশনে। অক্টোবরের শেষ, কলকাতায় বিশ্রী গরম থাকলেও, এখানে নেমে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। বেশি দেরি না করে দুজনেই উঠে পড়লাম একটা রিকশায়। তখনও জানিনা ঠিক কোন জায়গা তে নাচ হবে। এদিকে রাত হয়েছে, থাকার কোনও ঠিক নেই। মাঝপথে আমি অন্য রিকশা ধরে ছুটলাম হোটেল খুঁজতে। পুজোর মাস , সমস্ত হোটেল বুক করা আগে থেকে। অনেক খুঁজে পেতে একটা হোটেলে ঘর পেলাম। চাবি নিয়েই দৌড়লাম রঘুনাথ জিউ এর মন্দিরের দিকে। গিয়ে দেখি গোটা গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়েছে একফালি মাঠে । ওখানেই দেখা হল অমর্ত্য দার সাথে । রাবন কাটার ওপর ডকুমেন্টারি করছে । অনির্বাণ দা কে সেই যে এক ঝলক দেখলাম, তারপর ঐ ভিড়ের মধ্যে আর খুঁজে পেলাম না। অগত্যা গ্রামের লোকের সাথে কথা বলে এই নাচের প্রাচীনত্ব আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলাম । রাত তখন এগারোটা । বেজে উঠল সানাই, আর ঢোল। শুরু হল বাংলার দশেরা – ” রাবন কাটা ” নাচ ।
ইতিহাসের পাতায় –
নাচের অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দুর্গা পূজার শেষ অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিন থেকে। এই দিন অনুষ্ঠান শুরু হয় শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ এর অভিষেক এর মধ্যে দিয়ে। পূজার পর শিল্পীরা আসেন অস্থলে। তারা অস্থলের সামনের রাস্তায় নাচ করেন এবং রাবনের ভাই কুম্ভকর্ণ কে বধ করে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানটি শেষ করেন। কিন্তু আগে দশমীর দিন বধ করা হত ইন্দ্রজিৎ কে। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ একাদশীর দিন সকাল ৯ টার সময় দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে দল বেরিয়ে পরে। উৎসবের শেষ দিন অর্থাৎ দ্বাদশীর দিন পুজো সেরে প্রথম প্রহরেই বেরিয়ে পরে নাচের দল।
এই দিন রাবন কাটা অনুষ্ঠান হয়। রঘুনাথ জিউ এর মন্দির সংলগ্ন নিমতলায় আসর বসে সন্ধ্যে থেকে। রাস্তার দক্ষিণ দিকে উত্তরদিকে মুখ করে ট্রাক্টরের উপর “যুদ্ধং দেহি” রাবনের মূর্তি আর উত্তরদিকে মনোরম চৌদোলার উপর থাকে রণসাজে সজ্জিত রাম-সীতা আর লক্ষ্মণের মূর্তি।
তিন-চার ঘণ্টা ধরে চলে নাচ গান। রাত গড়িয়ে দুই প্রহরের অর্থাৎ রাত ১১ টা নাগাদ আসে রাবন বধের শুভক্ষণ। রঘুনাথ জিউ এর কাছ থেকে রাবন পর্যন্ত হনুমান নাচতে নাচতে আসে ২১ বার। সঙ্গে নাচে সুগ্রীব আর জাম্বুবান। মুখে বলা হয় – ” রাবন রাখব না রাবন কাটব, রাবন রাখব না রাবন কাটব ”
২১ বার যাতায়াতের পর জাম্বুবানের নির্দেশে হনুমান রঘুনাথ জীউয়ের কাছে রাখা তরোয়াল নিয়ে প্রবল গতিতে ট্রাক্টরে উঠে রাবনের গলায় কোপ বসায়। রাবনের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক মুহূর্তের মধ্যে খুলে নেয় রাবনের মুখোশ। কাটা মাথা আর রাবনের গলায় ধেলে দেয় লাল জল।
শেষ হয় ” রাবন – কাটা ” ।
” রাবন রাখব না রাবন কাটব, রাবন রাখব না রাবন কাটব “
নাচের মূল আকর্ষণ – মুখোশ –
এই নাচের মুখোশের মাধ্যমে অভিনয় করেন চারজন। এই রাবন কাটার মুখোশ তৈরি করেছেন প্রায় ২০০ বছর আগে বিশ্নুপুরের কাটানধারের বাসিন্দা সুকুমার বারিকের পূর্বপুরুষেরা। মুখোশ গুলি গামার কাঠের তৈরি, মাথার দিকে ৫০টি ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে শন পরিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথার চুল তৈরি হয়। দাঁতের ছিদ্র দিয়েই অভিনেতাদের দেখার কাজ সারতে হয়। তাদের মুখে থাকে মুখোশ , আর দেহে ফুলহাতা কোট আর পায়জামা। পোশাকের সাথে লাগানো থেকে মোটা পাটের দড়ির লোম। হনুমানের পোশাক “ঘি” রঙের, মুখোশ আর গায়ের লোম সাদা। জাম্বুবানের মুখোশটি ভালুকের মত।মুখ, চোখ, আর লোমের রঙ কালো। বিভীষণের আগাগোড়া লাল রঙ, মাথায় পাগড়ি, কপালে সাদা ত্রিশুল, ভ্রূ আর গোঁফ কোঁচকানো। সুগ্রীবের মুখোশ বানরের আদলে তৈরি। চুল শনের।
প্রচলিত লোক বিশ্বাস -“যে যিনি তরোয়াল দিয়ে রাবন কাটেন, তাঁর বংশ লোপ পায় “
নাচের ধরন –
বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে এই নাচের। এই নাচের দুই ভাগ – ১- দেবচাল এবং ২- রাক্ষস চাল।
প্রথমটি তে আছে লালিত্য, আর পরের টি তে আছে বলিষ্ঠতা। শিল্পীরা নিজেদের দক্ষতায় লাফ ঝাঁপ করেন।
প্রচলিত লোক বিশ্বাস যে যিনি তরোয়াল দিয়ে রাবন কাটেন, তাঁর বংশ লোপ পায়। আগেও দেখা গেছে যিনি রাবন কেটেছেন তিনি গাড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙ্গেছেন নয়ত পঙ্গু হয়ে গেছেন। এই কারনে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
কথিত আছে- রাবন কাটার পর রাবনের দেহের মাটি বাড়িতে রাখলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়।
গ্রামবাসীদের অনেকে জানালেন আগে বিশ্নুপুর রাজবাড়ীর সাহায্যে খুব ধুমধাম করে এই উৎসব পালন করা হত। কিন্তু বর্তমানে সরকার থেকে কোনও রকম সাহায্য পাওয়া যায়না। এই দুর্লভ লোকনৃত্য আজ তাই তিলে তিলে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে।
শেষ হল রাবন কাটা। নিস্তব্ধ বিষ্ণুপুরের জনমানবশূন্য রাস্তা দিয়ে ফিরছি আমরা দুজন। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। ফাঁকা মাঠের মাঝে “রাস মঞ্চের” অবয়ব। দূরে শিয়াল ডাকছে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ। মনে মনে দশমীর বিদায়বেলায় মাকে একটাই প্রার্থনা জানালাম – এই দুর্লভ নাচের যেন অবলুপ্তি না ঘটে । বেঁচে থাকুক বাংলার গৌরব – মোদের গরব, মোদের আশা ।