আমার “IKUS” এক্সকারসন এ যাওয়ার একটাই কারন ছিল – “Quedlinburg” , এক সহস্রাব্দেরও পুরনো শহর যা কিনা Magdeburg থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ।
.
.
সেদিন যেমন প্রচণ্ড বৃষ্টি , তেমন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। এই রকম এক দিনে আমরা সবাই মিলে বেরলাম … গন্তব্য ষ্টেশন ( Hauptbahnhof বলে জার্মান ভাষায় )। সেখানে পৌঁছে দেখি আমাদের IKUS এর ছাত্রি অপেক্ষা করছেন। আমরা পৌঁছতেই তিনি সবার নাম মিলিয়ে নিলেন আর প্রত্যেকের হাতে একটা করে ম্যাপ আর শিডিউল ধরিয়ে দিলেন, যাতে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে হারিয়ে না যাই। আমাদের অনেকের কাছেই জার্মানি তে আসার পর এটাই প্রথম একসাথে বেরোনো – অন্তত কিছু সময়ের জন্য পড়াশোনার চাপ ভুলে । খানিক ছুটকো ছাটকা আলাপ আর একগাদা সেলফি তোলার পর আমরা সবাই ট্রেনে উঠলাম। একজন সদা হাস্যময়ী ভদ্রমহিলা আমাদের Quedlinburg এ পৌঁছতেই অভ্যর্থনা জানালেন – তিনি আজকের পথ দেখাবেন ।
Quedlinburg শহর টা প্রায় ৮০ হেক্টর জায়গা নিয়ে যা কিনা পুরোটাই এখন UNESCO World Heritage City হিসেবে ঘোষিত। পুরো শহরের সমস্ত বাড়ী গুলো সেগুন কাঠের তৈরি, শতাব্দী প্রাচীন। পৃথিবীর বেশীরভাগ পুরনো শহর গুলো কোনও না কোনও সময়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। কখনও বিদেশী শক্তির আক্রমন, কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়- আবার কখনও বা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু এই শহর সেরকম কিছুর সম্মুখীন হয়নি, আর সেই জন্যই এখনও অবধি এই শহরের প্রত্যেক বাড়ী, প্রত্যেক অলি গলি তে লেগে আছে মধ্যযুগীয় ইউরোপিয় আবহ।
এই শহর তৈরি হয়েছিল খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী তে। যে সময়ে ভারতে পাটলিপুত্র তাঁর গৌরব গরিমা হারাচ্ছে – যে সময়ে বাংলায় পাল রাজারা , পশ্চিম ভারতে রাষ্ট্রকূট বংশ , আর মধ্য ভারতে গুজ্জর রা কনৌজের দখল নিয়ে যুদ্ধে নামছে। এই হল সেই সময় যখন ভারত থেকে বহুদূরে ইউরোপএ এই শহর গড়ে উঠছে। যা এত বছর পরেও সেই অতীতের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে আছে।
জেনে রাখুন – ভারতে গুর্জর রাজবংশের একটি মাত্র স্থাপত্য নিদর্শন আছে যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত- খাজুরাহ মন্দির
এই শহরে আমার সব থেকে বেশি ভালো লাগলো এই দেখে যে – এখানকার সাধারন মানুষ আজও তাদের ঐতিহ্য পরম্পরা কে অবিকল ভাবে রক্ষা করছে- এমনকি সমস্ত নতুন বাড়িঘরও সেই পুরনো দিনের মত সেগুন কাঠের তৈরি।
বাড়িঘরের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে জিনিসটা লক্ষণীয় সেটা হল গথিক স্টাইল। আকাশচুম্বী সূচলো চূড়া । আমাদের গাইড সাবিনা বলল এই শহরের স্থাপত্য প্রধানত রোমান আর রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি। অবশ্য প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য আমরা ভালো করে বুঝতে পারিনি।
ঐতিহাসিক সময়কালের দৃষ্টিকোণ থেকে Quedlinburg নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়, কারন জার্মানির ওটোমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম হেইনরিখের জন্মস্থান এই শহর। যিনি সমগ্র জার্মানি কে পুনর্গঠিত করেন ও তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ওটো কে শাসনভার দান করেন।
এই শহর অনেক মহিলা শাসক পেয়েছে, যাদের কথা তেমন শোনা যায়না। যেমন- প্রথম হেনরির বিধবা স্ত্রী Mathilde , তিনি প্রায় ৩০ বছর জার্মানি শাসন করেছিলেন। তাঁর নাতনি ( নাম একই ) , তিনিও দীর্ঘ ৩৩ বছর শাসন করেছিলেন। রাজপরিবারের পুরুষরা যুদ্ধে যেতেন, আর নারী সমগ্র সাম্রাজ্যের শাসন করতেন। প্রায় ৯০০ বছর এই শাসন ব্যাবস্থা চলেছিল।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আপনি যদি কোনদিনও জার্মানির এই ছোট্ট মধ্যযুগীয় শহর Quedlinburg এ যান, আপনি প্রেমে পড়বেনই – প্রেমে পড়বেন এই শহরের বাঁধানো রাস্তা গুলোর, প্রেমে পড়বেন শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট নদীর আর নদীর ধারের রুপকথার মত এক প্রাচীন দুর্গের। বৃষ্টি পড়ছে, আমরা হাঁটছি, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জার্মানির এক ছোট্ট রুপকথার শহরের রাস্তা দিয়ে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের গন্ধ গায়ে মেখে… যেখানে আজও অতীত কথা বলে – আজও চার্চের সামনে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সুরে ভরে যায় চারপাশ।
আমি তার সাহায্যের জন্য সাবিনা এবং ইংরেজিতে বাংলার অনুবাদের অনুবাদ করার জন্য আুরুগকে ধন্যবাদ জানাই। – অনির্বাণ সাহা।