বিশ্বাসে মেলায় বস্তু || গাজন উৎসব ও চড়ক ‘ কৃষ্ণদেবপুর, পশ্চিম বাংলা ২০১৪
অনুবাদঃ তমোঘ্ন সরস্বতী (ছাত্র, নীল রতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ )
ছবিঃ অনির্বাণ সাহা
To read the blog post in English click here.
“আপনারা কাল সন্ধ্যে অবধি থাকবেন তো?”, আমার উত্তরের অপেক্ষায় একদৃষ্টে বড় বড় চোখে সহাস্যবদনে শিশুটি তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমার সামনে এক মন্দির চাতাল ভর্তি ভগবান-রূপধারী লোক। অভিনেতাদের মধ্যে একদল প্রচণ্ড বিশ্বাসী, তাদের সারা শরীর লোহার শিকে বিদ্ধ, এমতাবস্থায় তারা আগুন নিয়ে খেলা দেখাতে ব্যস্ত। কে জানে, আশুতোষ হয়তো তাদের কাছে অল্পে সন্তুষ্ট হননা! বাবা মদ্যপ অবস্থায় ধেয়ে আসাতে বাচ্চা ছেলেটি আমাদের পেছনে লুকিয়ে পার পেল । ওর শেষ দশ টাকাটাও হয়তো আমাদের জন্য ঠাণ্ডা পানীয় আর প্রসাদ রাখতে চলে গেছে। আজ আমার কলমে এক বিশ্বাসের কাহিনী, একটি সম্পর্কের কাহিনী।
গাজন গ্রামবাংলার এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোক উৎসব। প্রত্যেক বছর চৈত্র মাসের শেষ দুই সপ্তাহে পালিত হয় এই উৎসব। বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে এই উৎসবের উৎস নিয়ে, তাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত বোধহয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করা নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে এটি দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতি উৎসর্গীকৃত এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজ গ্রাম বাংলার বিশেষ কিছু জায়গা গাজন উৎসব পালনের জন্য বিখ্যাত। তাদের মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হল বর্ধমান জেলার কুরমুন, এবং কৃষ্ণদেবপুর। আমাদের এবারের গন্তব্য কৃষ্ণদেবপুর।
কৃষ্ণদেবপুর পৌঁছানোর পর সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের ‘মন্দিরতলা’র দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। সেখানে পথনাটিকার প্রস্তুতি চলছিল। অভিনেতারা নিজেদের মুখ রঙ করছিল বিভিন্ন দেব-দেবীদের প্রচলিত রূপ অনুকরণ করার চেষ্টায়। নাটকগুলি প্রত্যেকটিই লোকমুখে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে সৃষ্ট।
চিত্র ৩ – কালীর জন্ম
ক্ষণিকের পরিচয়েই আমাদের সাথে শিশুটির সখ্য হয়ে গেল। বড় বড় জ্বলজ্বলে দুটি গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ চোখ নিয়ে শিশুটিও ওর সমবয়সী বাকিদের থেকে আলাদা। আমরা মুগ্ধ হয়ে ওর গল্প শুনতে লাগলাম। সে গল্প শুধুমাত্র গাজন উৎসবে সীমিত নয়, তার মধ্যে ছিল তার নৃত্য পরিবেশনের গল্প, তার পরীক্ষায় প্রথম আসার গল্প, আরও কত কিছু।
ওর বাড়িতে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার মন্দিরতলায় এসে উপস্থিত হলাম। অভিনীত পালাগুলি সবই শিব-পার্বতী, দুর্গা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে নির্মিত পৌরাণিক কাহিনী। ঘটনাচক্রে, গাজনের গল্প অনুযায়ী শিবের সঙ্গে হরকালীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই কাহিনী অবলম্বনে সৃষ্ট একটি পালাও দেখার সৌভাগ্য হল আমাদের। পালাটিতে মহাদেব শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর গোপিনীরা ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনের শেষে কালীর সাথে তাঁর বিবাহ হল। পালাটি শেষ হল কালীপুজোর জনপ্রিয় মূর্তির আদলে, মা কালী মহাদেবের ওপর দাঁড়িয়ে।
চিত্র ৫ – পথনাটিকায় যুবক কৃষ্ণ
রণিত, আমাদের সেই ছোট্ট বন্ধুটি, আমাদের সারা জায়গা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল, এমন অনেক জায়গা দেখার সুযোগ হল যেগুলি হয়তো আমরা নিজেরা ঘুরলে যাওয়ার কল্পনাও করতাম না। ভ্রমণ শেষে সে আমাদের রাতটুকু তাঁর বাড়িতে কাটিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল, সঙ্গে নৈশপ্রহরে গাজন প্রত্যক্ষ করার প্রলোভন। আমরাও এ সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।
রাতের অনুষ্ঠানে দিনের বেলার পথনাটিকা ছাড়াও ছিল বিভিন্ন বীভৎস উৎসর্গ ও নিজেদের শরীরে আঘাত করার খেলা, যা দেখে যে কোনও বীরপুরুষের হৃদয়েও কম্পন হতে বাধ্য। রণিত আমাদের সরবক্ষণের সঙ্গী। মানবদেহকে আহত করার দৃশ্য দেখে যখন তাঁর শিশু-শরীর ভয়ে কেঁপে উঠছিল, তখন সে আমার কোলে এসে আশ্রয় নিচ্ছিল।
চিত্র ৬ – দুর্গা
চিত্র ৭ – আগুন নিয়ে খেলা
চিত্র ৮ – অভিনয়ের ফাঁকে শিব-পার্বতীর বিশ্রাম
চিত্র ৯, ১০, ১১– অগ্নিদেব সহায়
আমার মতন একজন আপাদমস্তক শহুরে ছেলের কাছে একজন মানুষ তাঁর পেট লোহার শিকে বিদ্ধ করে সেই অবস্থায় আগুন লাগাচ্ছে সেই শিকে এই ছবিটি কল্পনা করাই এক অসম্ভব ব্যাপার, সেই অবস্থায় নৃত্য পরিবেশনা তো দূর অস্ত। সত্যি, মানুষ যে ভগবানের নামে কী না করতে পারে, তা ভাবা দুষ্কর। একজন মুখ্য পুরোহিত নিরলস মন্ত্রোচারণ করে যাচ্ছিলেন, এবং বাকিদের তাঁর মন্ত্রে বিশ্বাস করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এমন বহু সম্পাদনা ছিল যাতে শিল্পীরা নিজেদের শরীর কে ধারালো ছুরি, কাটারী দিয়ে ছিন্নভিন্ন করছিল। তবে এদের মধ্যে সবথেকে বেশী উল্লেখযোগ্য হল বাঁধা কালী। আর একটু বিষদে বলতে গেলে, একজন পুরুষ মানুষ কালী সেজে তারা শরীর শিক দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় ও কাটারী দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ছুটে আসছে, এবং দুজন শক্তিশালী পুরুষ তাঁর সেই রাগ দড়ি দিয়ে বেঁধে দমন করার চেষ্টা করছে। আমাদের বাঁধাকালী নির্ঘাত মন্ত্রের জোরে,বা কারণবারির কৃপায় ইহলোকে বসবাস করছিলেন না তখন, কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে এ জিনিস করা সম্ভব না। আমার দুর্ভাগ্য যে লোকের হুড়োহুড়ি তে বাঁধাকালীর চিত্রগ্রহণ করে ওঠা সম্ভব হয়নি।
পরের দিন আমরা চড়ক দেখতে গেলাম। তার রীতিনীতি আরও আজব। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখতেও বুকের পাটা লাগে। একবার প্রত্যক্ষ করে অবশ্য সে ভয় কেটে গেছে।
চড়কে ভক্তরা মূলত দুই শ্রেণীর। এক শ্রেণী, যারা ঠোঁটে ও কানে লোহার রড দিয়ে বিঁধে সারা মাঠ জুড়ে বিজয় দৌড় দৌড়োয়। আর এক শ্রেণী, যাদের পিঠে আংটা বিঁধে চড়ক গাছ থেকে ঝুলিয়ে দুলিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য আর যাই হোক, কোনও দুরবলহৃদয় ব্যক্তির জন্য নয়।
চিত্র ১২ – চড়কপুজোর ঠিক আগে
চিত্র ১৩ – দ্বিতীয় লোহার শিকটি ঠোঁটে ঢোকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুরোহিত মহাশয়
চিত্র ১৪ – আর এক ভক্তের আত্মত্যাগ
চিত্র ১৫ – পৃষ্ঠে বিঁধার সময়
কৃষ্ণদেবপুরের গোটা অভিজ্ঞতাটাই এক আলাদা রোমাঞ্চ। সেখানকার লোকেদের আতিথেয়তাও অনির্বচনীয়, ঠিক তেমনি অসাধারণ হল সেখানকার রীতিনীতি। সরল হৃদয়ের লোকগুলো সেখানে অল্পেতে খুশি হয়, এইজন্যই হয়তো আশুতোষ তাদের এত কাছের লোক। অন্যদিকে সম্পাদনাগুলি ঠিক ততটাই রোমহর্ষকর।
আমার কাছে এমন একটা জায়গায় এমন একটা সময়ে উপস্থিত থাকা যখন সমস্ত লোক একটা মন্দির চাতালে একত্রিত হয়, যেখানে চিত্রগ্রহণকারীদেরও লোকেদের নিজেদের লোক বলে গণ্য করে, এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কৃষ্ণদেবপুর আমার হৃদয়ে এক আলাদা স্থান করে নিয়েছে।
রণিত কিন্তু আমাদের তার বাড়িতে ঠিক নিয়ে গেছিল, আমাকে আর সৌরভকে। সেখানে তার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আমরা প্রশস্তির ঘুম দিলাম। অচেনা একটি ছেলেকে এমনভাবে বিশ্বাস করা, এ তো আমাদের কঙ্ক্রিটের জঙ্গলে মনে আনাও পাপ। আমার নিজেরও এই ব্যাপারটা ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমরা বেরিয়ে যাওয়ার পর রণিতের মা তার হাত দিয়ে চারটে সেদ্ধ ডিম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের জন্য। রণিত ও তার বন্ধু ছোটু আমাদের সাথে স্টেশন অবধি এল এবং ট্রেন ছেড়ে যাওয়া অবধি আমাদের সাথেই ছিল। ছেড়ে যাওয়ার সময় আমি রণিতের চোখের কোণে জল লক্ষ্য করলাম। এই দৃশ্য আমার বুকটাকে ভারী করে দিল। আবার অন্যদিকে খুব হালকা লাগছিল। এক অদ্ভুত অনুভূতি।
আমাদের সমাজে ভাল আর খারাপ একইসঙ্গে বর্তমান। এসবই আমাদের অবচেতন ও সচেতন মনের সৃষ্টি। আমরাই শুধু ভালটাকে দেখতে চাই, খারাপের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই।